শাহেদ হোছাইন মুবিন, উখিয়া।
রোহিঙ্গা আগমনের চার বছর পূর্ণ হলো আজ। মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সেনারা হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে জীবন বাঁচাতে প্রায় বার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে রোহিঙ্গারা। দিবসটি পালনের জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও করোনাভাইরাস ও গত ২০১৯ সালে মহাসমাবেশের ধাক্কায় এবার রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে রোহিঙ্গা নেতারা পুরনো দাবির গল্প এখনো বলে আসছে। দাবির মধ্যে রয়েছে: প্রথম, রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী এবং সে জন্য তাদের ন্যাটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে যার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে। ২. নাগরিকত্ব : প্রথমত, আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সিটিজেন কার্ড দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। তৃতীয়ত, একই সাথে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। চতুর্থ, প্রত্যাবাসন : রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। পঞ্চম, নিরাপত্তা : আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশবাহিনীর সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ৬ষ্ট, জবাবদিহিতা : বার্মার স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির মতো কোনো ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করতে হবে। শুরুর দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কিছুটা আলাপ-আলোচনা হলেও বর্তমানে থমকে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সব ধরনের আলোচনা। মাঝখানে কয়েকবার সরকারিভাবে প্রত্যাবাসনের সব আয়োজন হলেও কোনো রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে রাজি হয়নি নিজ দেশে। বরং জুড়ে দিয়েছে নতুন শর্ত। এতে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। এদিকে ৪ বছরে রোহিঙ্গাদের কর্মকাণ্ডে কেবল অতিষ্ঠ নয় বরং রোহিঙ্গাদের নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের। কারণ রোহিঙ্গারাই এখন স্থানীয়দের গুম-খুনসহ নানান অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না। আর সব অপরাধ ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকে একটি সুবিধাভোগী মহল। এতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগামী দিনের কথা চিন্তা করে রীতিমত অস্থিরতায় আছে স্থানীয়রা। এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অন্য ভাসানচরসহ অন্য জেলায় বা অন্য কোনো দেশে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। কক্সবাজারের ৩৪টি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ বছর ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর তারিখ ঠিক হলেও নতুন করে নিপীড়নের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের উদ্যোগকে ‘প্রতারণা’ বলছেন কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠনের একজন নেতা। থাইংখালী তাজনিমার খোলা ক্যাম্পের একটি ঝুপড়িতে বসবাস করছেন মাইমুনা খাতুন (২৮)। তার কোলে একটি শিশু, বয়স ৩ বছর। আর একটি মেয়ে পাশে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। নাম জানতে চাইলে বলে, আছিয়া (৭)। স্বামীর কথা জানতে চাইলে মাইমুনা অশ্রু ফেলে জানান, সেদিন তারা প্রতিদিনের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় মিয়ানমার জান্তাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে শিশু দু’টিকে নিয়ে বাইরে এসে দেখি, সেনারা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সকালে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার স্বামী শামশুল আলমকে সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। উপায়ান্তর না দেখে পাড়ালিয়াদের সাথে আজকের এই দিনে থাইংখালী রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে তাজনিমার খোলা ক্যাম্পে আশ্রয় নিই। তিনদিন তিনরাত অবিশ্রান্ত হেঁটে আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। শিশু ২টির অবস্থা আরও কাহিল। এ সময় কে বা কারা এসে খাবার দিলে আমরা কোনো রকমে বেঁচে থাকি। মাইমুনা তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারানো স্বামীর জন্য বারবার কাঁদছিলেন। ৪ বছর শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাকিমপাড়া ক্যাম্পের মাঝি নবী হোছন জানান, যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের সাহায্য-সহযোগিতা, থাকা-খাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছে তাতে তারা খুশি। তবে তারা সুখী নয়। জানতে চাইলে বলেন, মাতৃভূমির জন্য বারবার মন কাদঁছে। সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য বেশ তৎপর হলেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় চিন্তিত আছি। কবে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবো, এ চিন্তায় দিন গুনছি। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠনের নেতা সিরাজ বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জায়গা এখনো নিরাপদ নয়। তাদের নিয়ে যদি ক্যাম্পে রাখা হয় তাহলে বাংলাদেশের ক্যাম্পই তাদের জন্য ভালো। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর দ্বিতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আপত্তির কারণ বললেন তিনি। রোহিঙ্গারা মনে করেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের জন্য এখনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি। আবার সেখানে ফিরে গেলে মিয়ানমার তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবে না এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের জন্য তৈরি করা ক্যাম্পে প্রায় জিম্মি অবস্থায় তাদের রাখা হবে। কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ বলেন, আজ ২৫ আগস্ট যাতে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে অপ্রীতিকর কিছু ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সাথে দফায়-দফায় বৈঠক করেছে। নিদের্শনা দেয়া হয়েছে, এদিন ক্যাম্প থেকে কোনো রোহিঙ্গা বাইরে যেতে পারবে না। ৪/৫ জন রোহিঙ্গা জমায়েত হতে পারবে না। এছাড়া সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, প্লেকার্ড, ব্যানার ফেস্টুন প্রদর্শন-বহন সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। কুতুপালং ক্যাম্পের ইনচার্জ (উপ-সচিব) মো. রাশেদুল ইসলাম জানান আজ রোহিঙ্গা আগমনের ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই রোহিঙ্গারা যাতে এদিনে ক্যাম্পে কোনোরূপ কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সে জন্য ক্যাম্প প্রশাসনকে তৎপর রাখা হয়েছে। দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ক্যাম্প মাঝিদেরও। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেছেন, যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।