রামু প্রতিনিধিঃ
কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বাঁকখালী নদীর দু’পাড়ে ছিল হাজারো নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। নদীতে ভাসছে দৃষ্টিনন্দন কল্পজাহাজ। বাঁশ, বেত, কাঠ এবং রঙিন কাগজ দিয়ে অপূর্ব কারুকাজে তৈরি নদীতে ভাসমান এসব জাহাজে চলছে যেন বাঁধভাঙা আনন্দ উৎসব। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবকরা দল বেঁধে নানা বাদ্য ঢোল বাজিয়ে জাহাজে নাচছে ও গাইছে। আবার কোনো কোনো জাহাজে চলছে বুদ্ধ কীর্তন।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ২ দিনব্যাপী উৎসবের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) বিকেলে কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফকিরা বাজারের পূর্বপাশে বাঁকখালী নদীতে ‘সম্প্রীতির জাহাজে, ফানুসের আলোয় দূর হোক সাম্প্রদায়িক অন্ধকার’ স্লোগানে জাহাজ ভাসানোর আয়োজন করা হয়। ব্যতিক্রমী এ আনন্দ উৎসব উদ্বোধন করেন জেলার শীর্ষ নেতারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা জায়, রামুর পূর্ব রাজারকুল, হাইটুপী রাখাইনপাড়া, হাইটুপী বড়ুয়াপাড়া, দ্বীপ-শ্রীকুল, হাজারীকুল, জাদিপাড়া ও মেরংলোয়া গ্রাম থেকে মোট আটটি কল্পজাহাজ নদীতে ভাসানো হয়েছে। সাত-আটটি নৌকার ওপর বসানো হয়েছে এক-একটি কল্পজাহাজ। বিভিন্ন বৌদ্ধ পল্লীতে এবারও তৈরি করা হয়েছে কল্প জাহাজ। বাঁশ, কাট, বেত, কাগজে রংয়ের কারুকাজ করে অভিজ্ঞ কারিগরেরা দৃষ্টিনন্দন এ কল্পজাহাজ তৈরি করেন। বার্মিজ ভাষায় কারিগরদের ‘ছেরা’ বলা হয়।
আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলীর কারণে খুব সহজেই এসব কল্পজাহাজ মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। প্রতিটি জাহাজেই আছে একাধিক মাইক। ঢোল, কাঁসর, মন্দিরাসহ নানা বাদ্যের তালে জাহাজের ওপরে শিশু-কিশোর ও যুবকেরা নেচে গিয়ে মেতেছে অন্যরকম আনন্দে। জাহাজ নিয়ে ভেসে এপার থেকে ওপারে যেতে যেতে মাইকে চলে বৌদ্ধ কীর্তন-নাচসহ নানা আয়োজন।
জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অর্পণ বড়ুয়া বলেন, ১৯৭১ সালে যেভাবে সবকিছু ভুলে স্বাধীনতার জন্য যাপিয়ে পড়েছিল বাঙালি। সে ঐতিহ্যে আঘাত করছে দুষ্কৃতিকারীরা। সেই প্রেক্ষাপটে এই জাহাজ ভাসা উৎসবে মুসলিম,হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে উসকানিদাতাদের কালো দাত ভেঙে দেওয়ার শপথ নেবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ।
ওয়াল্ড বুদ্ধিস ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সম্পাদক রজত বড়ুয়া বলেন, চলমান যে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। রামু যে একটি অসাম্প্রদায়িক এলাকা এটি প্রমাণ করে এ উৎসবে আসা সব ধর্মের মানুষের সরব উপস্থিতি।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, রামুর বাঁকখালী নদীতে যুগ যুগ ধরে এ উৎসব হয়ে আসছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি নদীতে চলে জাহাজ ভাসানোর আনন্দ। আর এ আনন্দে সামিল হন হাজারো বৌদ্ধ নরনারী। শুধু বৌদ্ধরা নন, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং পর্যটকদের অংশ গ্রহণে এ উৎসব এখন হয়ে ওঠে এক অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলা।
তিনি আরও বলেন, আজ হতে প্রায় দুইশ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এ উৎসবের প্রচলন হয়। সেই থেকে প্রায় শত বছর ধরে এ উৎসবকে ঘিরে রামুর বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে এ আনন্দায়োজন চলছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএও) প্রণয় চাকমা বলেন, এ জাহাজ ভাসা উৎসব ঘিরে কড়া নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মূলত উৎসবটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হলেও এখানে সব ধর্মের মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। যা সব ধর্মের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল,কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় প্রবারণা পূর্ণিমা ও কল্প জাহাজ ভাসা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ডালিম বড়ুয়ার সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রামুর কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ভদন্ত শীলপ্রিয় মহাথের, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, রামুর সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিগ্যান চাকমা ও রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল হোসাইন।।
উল্লেখ্য, অর্ধশতাব্দী ধরে রামুতে এ উৎসবের আয়োজন করা হলেও গত ২০১২ ও ১৩ সালে এ উৎসব উদযাপন করা হয়নি। রামু বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনায় ওই দুই বছর এ উৎসব উদযাপন হয়নি। দু’বছর পর আবারও প্রতি বছর থেকে সাড়ম্বরে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে।