নিজস্ব প্রতিবেদক।
বর্ষণ আর উজানের ঢলে ফুঁসে উঠছে বাঁকখালী আর মাতামুহুরি নদী। ফলে এদের অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার ৪১ টি ইউনিয়নের সাড়ে ৪শ’ গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। করোনার দুঃসময়ে হানা দেওয়া এ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
বন্যায় বিপর্যস্ত খাল-নদী অববাহিকার লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগে দিনানিপাত করছেন। বিশুদ্ধ খাবার পানির পাশাপাশি রান্নার জায়গার সংকটে শুকনো খাবারের জন্য হাহাকার করছেন এইসব বানভাসিরা। আগামী ২৪ ঘণ্টা নদী-খালের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
জেলা প্রশাসন বলছে, বন্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্যা কবলিতদের আশ্রয়ের জন্য সাইক্লোন শেল্টার (বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্র) সহ ৫ শ’ ৮০ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নতুন করে খোলা হয়েছে আরোও ৩০টি।
ইতোমধ্যে ৯ উপজেলার বন্যা কবলিত মানুষের সহায়তায় ১৩৫ মেট্রিক টন চাল, শুকনো খাবার এবং শিশু ও গোখাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা বণ্টন শুরু হয়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানিসহ যেকোনও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী পানিবন্দি পরিবার ৫৫ হাজার ১শ ৫০ জন এবং লোকসংখ্যা প্রায় ২ লাখ। কিন্তু বন্যা কবলিত অর্ধশতাধিক ইউনিয়নের বেশ কিছু জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এসব ইউনিয়নে পানিবন্দি লোক সংখ্যা দুই লক্ষাধিক। আর এসব পানিবন্দি মানুষ পরিবার ও গবাদি পশু নিয়ে চরম দুর্ভোগ ও খাদ্য সংকটে পড়েছে।
এদিকে বন্যার পানি বেড়ে জেলার ৯ উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁকখালী, মাতামুহুরি ও শরেশ্বরীসহ আরোও কয়েকটি নদী অববাহিকার দু’পাড়ের প্রায় সবকটি ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত।
মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) উখিয়া উপজেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশু নিহত হয়েছেন এবং বুধবার (২৮ জুলাই) দুপুরে নতুন উপজেলার ঈদাগাঁও’র দরগাহ পাড়া এলাকায় বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে এক পরিবারের ৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। এতে রেহিঙ্গাও একই পরিবার ৫ জনসহ অতন্ত ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
ফুলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে ঈদগাঁও উপজেলার বাজারসহ ষ্টশনে পানি প্রবেশ করেছে। প্লাবিত হয়েছে ওই উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন।
বন্যা কবলিত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুকনো জায়গার অভাবে রান্নার বিড়ম্বনায় পড়েছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। বয়োবৃদ্ধ ও শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন বানভাসিরা। অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও বেশিরভাগ পরিবার নিজ বাড়িতেই পানিবন্দি জীবন যাপন করছে। কেউবা স্ত্রী সন্তান নিয়ে নৌকায় সংসার পেতেছেন। স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নারী ও কিশোরীরা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ পারভেজ চৌধুরী বলেন, উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সাংবারাংয়ের বেশ কয়েকটি গ্রামের অন্তত সাত শতাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে যেতে প্রশাসনের মাইকিং অব্যাহত রয়েছে।
ঝিলংজা ইউনিয়নের খরুলিয়া কোনারপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলাম জানান, চারিদিকে শুধু পানি। বাঁকখালী নদীর পানির তোড়ে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এলাকার কয়েকটি বাড়ি-ঘর ভেসে গেছে। ঘর হারা লোকজন স্থানীয় একটি স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। বানভাসি যাদের নৌকা রয়েছে তারা নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। শুকনো জায়গার অভাবে অনেকের গবাদি পশু পানিতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য ও ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল জাহান চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি ঢলে আমার বাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে। বর্তমানে বাড়ির ভিতরে হাঁটু পরিমাণ পানি।
তিনি জানান, ঈদগাঁও পূর্ব ফরাজী পাড়ায় ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট। মধ্যম পোকখালীর ৩নং ওয়ার্ড মৌলভী নাছির আহমদের বাড়ির পাশেও নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। এতে ডুবে গেছে অনেক বসতবাড়ি। বৃহত্তর ঈদগাঁও বাজারও ডুবে গেছে পানিতে।
বাঁকখালী নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে রামু সদরের উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উপজেলার প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েকশ’ হেক্টর বীজতলা। এই দুই উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, ঈদগড়, চাকমারকুল, মিঠাছড়ি, ফঁতেখারকুল ও সদরের ঝিলংজা, পিএমখালী এবং ভারুয়াখালী ইউনিয়ন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঝিলংজা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান জানান, তার ইউনিয়নের ৫ হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রায় ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দি। তার ইউনিয়নে হতদরিদ্র পরিবারগুলো শিশু সন্তানসহ খাদ্য সংকটে পড়েছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে মাতামুহুরি নদীর পানিতে চকরিয়া, পেকুয়া ও ঈদাগাঁও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন। এসব উপজেলার নদী তীরবর্তী বেশিরভাগ পরিবার এখনও পানিবন্দি রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ পানিবন্দি রয়েছে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার।
অতিরিক্ত ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসৌদ্দজা নয়ন বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে কিছু ক্যাম্প প্লাবিত হয়েছে। তবে কয়টি ক্যাম্প প্লাবিত হয়েছে তা জানতে সময় লাগবে। বিচ্ছিন্ন কিছু পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টা হতে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১১৫ মিলিমিটার। সাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বলবত্ রয়েছে। আরো দু’এক দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘটতে পারে পাহাড় ও ভূমি ধসের ঘটনাও।
কক্সবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, বুধবার (২৮ জুলাই) সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত মাতামুহুরি নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বাঁকখালী নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, ‘বন্যায় পানিবন্দি লোকজনকে নিরাপদ স্থানে এবং আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তাদের সহায়তায় চাল ও শুকনো খাবারসহ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও শিশু ও গো খাদ্য বিতরণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’