শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ০৮:২২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

প্রবল বর্ষণে দু’সপ্তাহর ব্যবধানে উখিয়ায় পাহাড় ধসে মৃত্যু ১৪,পানিবন্দী হাজারো মানুষ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
  • ৯৮ বার পঠিত

।। এম আর আয়াজ রবি, বিশেষ প্রতিবেদক।।

উখিয়ায় ভারী বৃষ্টিতে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৃথক পাহাড়ধসে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্য একজন শিশুও রয়েছে। পাহাড় ধসের ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছেন। ইতিপূর্বে গত ১৯ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একই ঘটনায় পাহাড়ের মাটিচাপায় মারা গেছেন ২ স্থানীয় ও ১০ রোহিঙ্গা মিলে ১২ জন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ বুধবার ভোরের পাহাড় ধসের ঘটনায় ২ জন মারা যাওয়ায় মৃত্যুর তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আরো দীর্ঘ হতে পারে মৃত্যুর মিছিল।

এদিকে গত কয়েকদিনের অতি বৃষ্টিতে একাধিক স্পটে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। মাটি সড়কের ওপরে পড়ে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে বেশ কয়েক ঘণ্টা যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরে সেনাবাহিনী বুলডোজার দিয়ে মাটি সরালে বেলা ১১টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানা যায়।

প্রবল বর্ষণে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনেক বাড়ি-ঘর, হাট-বাজার, ক্ষেত-খামার, নদী-নালা, খাল-বিল, নিম্নাঞ্চল পানিতে একাকার হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমুহের অফিস, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বাসস্থান নির্মান, ওয়্যারহাউজ নির্মানসহ অন্যান্য লজিস্টিক সরবরাহের শেড নির্মানের ফলে পাহাড়ি মাটি কর্তন, বনভুমি সাবাড়, চাষযোগ্য ভুমি ভরাট করে উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত, বাড়ি ঘর, স্থাপনা নির্মাণের কারনে সুষ্ঠু পয়:নিষ্কাশন ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টির পানি বন্দী হয়ে অনেক গ্রাম/এলাকা প্লাবিত হয়ে আছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার স্টেশনের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানান, লঘুচাপের প্রভাবে গত দেড় সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার জেলায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার (২ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে বুধবার (৩ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত কক্সবাজারে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৭৪ মিলিমিটার। দিনের বেলা বৃষ্টির তীব্রতা কম হলেও মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে আবারো ভারী বর্ষণ হয়েছে। শনিবার (২৯ জুন) থেকে বুধবার (৩ জুলাই) সকাল পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬৮ মিলিমিটার। দিনে বৃষ্টিপাত কম হলেও সন্ধ্যার পর থেকে রাতে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস মতে আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে বৃষ্টিপাত। এছাড়াপাহাড় ধসেরও সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

উখিয়ার রাজাপালং, রত্নাপালং, হলদিয়া পালং, জালিয়া পালং ও পালংখালী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে পাহাড়ে, ঢালু ও পাদদেশে বসবাসরত স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা পাহাড় ধসের আতঙ্কে রয়েছেন।

উখিয়া ঘিলাতলীপাড়া এলাকার নুরু বলেন, অপরিকল্পিত বাড়ি ঘর স্থাপনা নির্মানের খেসারত সবাই পাচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে অসংখ্য মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো খুবই কষ্টে কালাতিপাত করছে।

বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেছে উখিয়ার কুতুপালং, মাছকারিয়া, ডিগলিয়া, সিকদারবিল, তুতুরবিল, রত্নাপালং এর নিম্নাঞ্চল, হলদিয়া পালং এর নিম্নাঞ্চল, পালংখালী ও জালিয়াপালং ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল। উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ উখিয়া উপজেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিগণ বিভিন্ন প্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছেন। সাথে রয়েছেন জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, থানা প্রশাসন, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
উখিয়া সদর ইউপি’র সিকদারবিল এলাকার জনৈক শাহ আলম বলেন, আমরা সাধারণ বেপারী। মুরগী বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চালাই। এই বর্ষায় আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। বাড়িঘরে পানিতে একাকার। মুরগী রাখার স্থান পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক মুরগী মারা গেছে। আমি স্বল্প আয়ের একজন বেপারী। আমার প্রায় ১২ হাজার টাকার মুরগী শেষ হয়ে গেছে। আমাদের দেখতে কোন সহৃদয় ব্যক্তি আসেনি, কোন খবর নেয়নি।’

রুমখা এলাকার জনৈক আলম বলেন, ‘রেজু খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রুমখা এলাকার প্রতিটি বাড়ি-ঘরের ওঠানে পানি উঠে যায়। ডুবে গেছে অনেকের বাড়ি ঘর, উঠোন,ক্ষেত খামার’।

জালিয়া পালং ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের গনি বলেন, উচু এলাকায় পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে এবং নিচু এলাকায় পানি ওঠানে ও বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করেছে। এবারের প্লাবনে এমন এলাকায় পানি গেছে জীবনে যেসব এলাকায় পানি উঠার ঘটনা চোখে পড়েনি। নিচু এলাকার অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারছেনা। সব মিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই’।

তিনি বলেন, উখিয়ার বালুখালীর ৯,১০ নম্বর মধুরছড়ার ৬,৭ নম্বর এবং চাকমারকুলের ২১ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরসহ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শিবির পাহাড়ে অবস্থিত। ফলে এসব শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা খুব আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের মাবিয়া খাতুন বলেন, “মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর এই ক্যাম্পের পাহাড়ের নিচে ঘর করে চার সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলাম। প্রায় সময় এখানে পাহাড় ধস ও ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে। তাই ভারী বৃষ্টি হলেই খুব আতঙ্কে থাকি।”

উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসেন এর মতে-‘বুধবার (৩ জুলাই) ভোরে উখিয়ার ৮ ও ১১নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, ১১ নম্বর ক্যাম্পের এফ/১ ব্লকের বাসিন্দা দিল মোহাম্মদের ছেলে মো. আনোয়ার হোসেন (২১) ও ক্যাম্প-৮ ইস্টের ৪১ নম্বর ব্লকের মো. আলমের (বাঙ্গালী) ছেলে সিফাত (১৩)’।
বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি আরো বলেন, “বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এফ/১ ব্লকে এবং ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৪১ নম্বর ব্লকে চলমান ভারীবৃষ্টিতে পাহাড়ের উপরে থাকা শেল্টার ধ্বসে মো. আনোয়ার হোসেন নামের একজন রোহিঙ্গা পাহাড়ের মাটিতে চাপা পড়ে এবং মামার শেডে বেড়াতে এসে সিফাত নামের এক শিশু মাটি চাপা পড়ে নিহত হয়। এছাড়া আরও কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। অন্যদিকে প্রবল বর্ষণে অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।”

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা) উখিয়া উপজেলা সভাপতি আয়াজ রবি বলেন, ‘ক্যাম্পে পাহাড়ের ঢালু ও পাদদেশে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বসতি। সপ্তাহব্যাপী ভারী বৃষ্টির ফলে পাহাড়ের ঢালু ভুমিতে বর্ষার পানি প্রবেশ করে নরম ও তুলতুলে হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার পাহাড়ি ভুমি বালি মিশ্রিত ঝরঝরে হবার কারনে ভারী বৃষ্টিতে তা হালকা হয়ে পড়ছে। তাই গেলো দু’সপ্তাহের ব্যবধানে ভুমি ধসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই ১৪ জনের মতো মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। যেভাবে বৃষ্টির ধারা অব্যাহত আছে ভুমি ধসে প্রানহানির পরিমান বাড়তে পারে। রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর দুর্যোগকালীন সময়ে শেল্টারের কোন ব্যবস্থা না থাকায়, এক প্রকার নিরুপায় হয়ে রোহিঙ্গারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এভাবে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে না নিলে ক্যাম্পে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, টানা বর্ষণে পাহাড় ধসে মৃত্যু এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। ভারী বর্ষণে প্লাবণের শঙ্কা রয়েছে। জেলার নদীগুলো ঢল নামলে এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকার আগাম প্রস্তুতি নিতে ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ডিসি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Developed By Bangla Webs