রিয়াজ উদ্দিন:
কক্সবাজারে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা তৈরি ও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা এবং কিশোর কিশোরীদের দক্ষতা উন্নয়নে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে জলবায়ু ন্যায্যতা ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে CJRF, Health and Environment Foundation ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এক সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সিইএইচআরডিএফ এর প্রধান ও জলবায়ু কমীর্ মোহাম্মদ ইলিয়াছ, কোস্ট ফাউন্ডেশনের কর্মকতার্ মোঃ আরিফ উল্লাহ ও আহমেদ উল্লাহ, উত্তরণ মডেল কলেজের প্রভাষক রিয়াজ উদ্দিন, কক্সবাজার ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক এহসানুল করিম প্রমুখ।
এসময় প্রধান অতিথি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ফরিদুল আলম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকে জলবায়ু ন্যায্যতা ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। তিনি আরো জানান, মানুষের নির্বিচার আচরণে পরিবেশ হয়ে পড়েছে রুগ্ন—ভগ্ন কোনো বৃদ্ধের মতো, যেন তাকে দেখার কেউ নেই। ভগ্ন শরীরে সে আর কতটা পথ এগোবে একাকী! রুগ্ন পরিবেশের প্রভাব এসে পড়ছে মানুষের নিত্য জীবনযাত্রায়। পরিবেশের প্রতি মানুষের অযাচিত আচরণের ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত, বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। খাবারের পানির গভীরতা দিনিদিন নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশ্বে ভয়াবহভাবে এগিয়ে আসছে বন্যা—খরাসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে, তবুও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে এবং সরকারের একার পক্ষে সম্পূর্ণ নিরসন করা কঠিন। এর জন্য সমাজের সর্বস্তরের লোকদের এগিয়ে আসা ও অংশগ্রহণ করা উচিত। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক—তৃতীয়াংশ যুবক (যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর)। যদি তরুণ প্রজন্মকে জলবায়ু শিক্ষা, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে তারা ভবিষ্যতে দেশ যে অনিবার্য সংকটের মুখোমুখি হবে, তা মোকাবিলা করার জন্য ভালোভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
পরিবেশের এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত মানুষ। মানুষ সচেতন হলে এবং পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় না। এই সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার গোড়া থেকেই। তাই প্রয়োজন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা থেকেই সচেতনতার সূচনা করা।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, বর্তমানে কক্সবাজারে একটু ভারী বর্ষণ হলে রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের নিম্ন এলাকায় পানিতে প্লাবিত হয় শত শত পরিবার। তাছাড়া সদরের লিংকরোড, ঝিলংজা, পিএমখালী, উখিয়া উপজেলার অনেক উচু এলাকায় ও এখন ভারীবর্ষণে পানিতে তলিয়ে যায় হাজার হাজার পরিবার। উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে এই পরিবারগুলো। এই সকল সমস্যার একটাই কারণ Climate Change (জলবায়ু পরিবর্তন)। বাংলাদেশে ছয় ঋতুর দেশ হলেও এখন চার ঋতুর বৈচিত্রতা সকলের কাছে দৃশ্যমান। হেমন্ত ও বসন্ত ঋতু বাংলাদেশে বর্তমানে নেই বললেই চলে। বর্ষাকালে(জুন—জুলাই) বৃষ্টি হয়না, বসন্তকালে বৃষ্টির দেখা মিলে, শীতকালের কোন নির্দিষ্টতা লক্ষ্য করা যায় না। এসব কিছুর মূল সমস্যার একটাই কারণ; যা হচ্ছে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ও মানবসৃষ্ট কারণ। মানুষ অনবরত গাছ কাটার ফলে এসব সমস্যা প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে ও ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হবে। আমরা যদি এসব পরিত্রাণ চাই তাহলে সকলেই একত্রিত হয়ে বন উজাড় ও পাহাড় কাটা বন্ধ করে বৃক্ষরোপণে ধাবিত হতে হবে এবং প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি জলবায়ু কর্মী মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হুমকির সম্মুখীন আজ সারা বিশ্ব। এই হুমকি মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সবাইকে একযোগে দাঁড়াতে হবে বিপর্যয় রুখতে। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক কাবর্ন নির্গমনে ০.৫৬ শতাংশ অবদান রাখে, তবু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের ক্ষতির অনুপাত অপ্রতিরোধ্য। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় ক্ষয়, খরা, তাপ এবং বন্যা—সবই আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আমাদের অবকাঠামো এবং কৃষিশিল্প ধ্বংস হচ্ছে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ, হ্রাস ও মোকাবিলায় যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নের কারণে আমাদের জিডিপি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং গড় আয় ২১০০ সালে ৯০ শতাংশ কম হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু তার নিজ অবস্থানে স্থির থাকে না। এটা সর্বদা পরিবর্তনশীল। তাহলে এটা নিয়ে এত মাতামাতি কেন? মাতামাতির কারণ রয়েছে। বিশ্ব জলবায়ুর স্বাভাবিক পরিবর্তন এখন আর দেখা যাচ্ছে না। পরিবর্তনের মাত্রা খুব বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকির ক্ষেত্রে বংলাদেশ সম্পর্কে আশঙ্কা দেশের বৃহৎ অংশ কোনো একসময় সমুদ্রের গর্ভে হারিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ সংকটের আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়ার আগেই প্রয়োজন প্রতিরোধ।
এছাড়া রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ পোড়ানোর কারণে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। এই রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থগুলো উৎপাদন হয় বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে। যেখানে থাকে মানুষের চরম অর্থলালসা। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে সবচেয়ে বড়ো পদক্ষেপ হলো মানুষকে সচেতন করা। জলবায়ু পরিবর্তিত হয় এমন কুজ না করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়ে সচেতন করা। তবেই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো সম্ভব হবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট কারণকেই মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়। মানুষ যে জলবায়ু পরিবর্তন করছে, এ বিষয়ে বেশ শক্ত প্রমাণ আছে। আর এ প্রত্রিয়াটি মানুষ সম্পাদন করছে গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মিথেনের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদন করে। শিল্পবিপ্লব—পরবর্তী ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত অধিক হারে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাস নির্গমনের ফলে বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বেড়ে চলেছে, যার জন্য দায়ী মানুষই। কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, জমি ব্যবহারে পরিবর্তন, বৃক্ষনিধন, বন উজাড়, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, মিথেন গ্যাস নির্গমন, কৃষি প্রভৃতি কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও নদীর নাব্যতা হ্রাস, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, তেলদূষণও জলবায়ু পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এছাড়া বক্তব্য রাখেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা(ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সদস্য ও কোস্ট ফাউন্ডেশন কক্সবাজার এর কর্মকর্তা মোঃ আরিফ উল্লাহ, আহমেদ উল্লাহ, ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক এহসানুল করিম। সভাপতির সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।